আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের রূপরেখা

আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের রূপরেখা

{:bn}

ওয়াজ মাহফিল এদেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশআবহমান কাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। ওয়াজ মাহফিল থেকে মুসলমানদেরকে ঈমান, আমল, আচার-আচরণে বলিয়ান আদর্শ মুসলিম হওয়ার দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয় ওয়াজ মাহফিল যদি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত হয় তাহলে সমাজে নীতি-নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি পাবে, অপরাধ প্রবণতা কমবে, সুন্দর ও আদর্শ কল্যাণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।


‘ওয়াজ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ উপদেশ, নসিহত। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমের বিভিন্নভাবে ‘ওয়াজ’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। এছাড়া সমার্থক শব্দেও উপদেশ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘(আল্লাহ) তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করো’ (কুরআন, ১৬:৯০) তুমি উপদেশ দিতে থাকো, কারণ উপদেশ মুমিনদেরই উপকারে আসে।’ (কুরআন, ৫১:৫৫)


রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে দীনের পথে আহ্বান করতেন। তিনি বলেছেন, ‘সদুপদেশই দীন।’ (সহীহ মুসলিম: ৯৫) আরো বলেছেন, আমার কাছ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছিয়ে দাও।’ (সহীহ বুখারী: ৩৪৬১)


তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মানুষকে সদুপদেশ দেওয়া উলামায়ে কিরামের দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল যেন থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর তারাই সফলকাম।’ (কুরআন, ৩:১০৪)


সুতরাং বোঝা গেল, ওয়াজ’ তথা দীনি উপদেশ প্রদান ইসলামে নতুন কোনো সংযোজন নয়, বরং আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত ও রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থা। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার ভিত গড়ে তোলা এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের প্রধান মাধ্যম এটি। আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত মানুষকে আল্লাহর পথ প্রদর্শন করা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে! তবে তা তখনই সফল ও অর্থবহ হবে— যদি তা হয় সঠিক ও সুন্দর পদ্ধতিতে। কীভাবে সুন্দর পদ্ধতিতে ওয়াজ মাহফিল করা যায়, এটাই এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।


উদ্দেশ্য: ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হতে হবে


. কুরআন-হাদীসের আলোকে এবং সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে ইসলামের সঠিক ধারণা তুলে ধরা


. প্রচলিত কুসংস্কার সামাজিক অসঙ্গতি এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি জ্ঞান, প্রজ্ঞা বিচক্ষণতার মাধ্যমে দূর করার প্রয়াস চালানো


. নীতি-নৈতিকতায় সমৃদ্ধ দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব আদর্শ সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করা


. সর্বোপরি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা


 


পক্ষান্তরে মাহফিলের আয়োজক কিংবা ওয়ায়েজের (যিনি ওয়াজ পেশ করেন) উদ্দেশ্য যদি পার্থিব কোনো কিছু হয়, তাহলে তারা এজন্য আল্লাহর নিকট কোনো বিনিময় পাবেন না; উপরন্তু আখিরাতে তাদেরকে আল্লাহর নিকট ইবাদতের নামে লৌকিকতার কারণে আযাবের মুখোমুখি হতে হবে। এ ধরণের ওয়াজ মাহফিল থেকে সমাজেরও কোনো উপকার হয় না।


সময়সীমা: গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ এবং কৃষক গৃহিণীদের জন্য ওয়াজ মাহফিলের জন্য আদর্শ সময় বাদ আসর থেকে রাত ৯:০০টা থেকে ১০:০০টা তারপর মাহফিল স্থলে এশার সালাত আদায়ের মাধ্যমে মাহফিল সমাপ্ত হলে সেটা হবে সব দিক থেকে সুন্নাহ সম্মত ও যথার্থ কারণ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে যাওয়া পছন্দ করতেন এবং এশার পর আলাপচারিতা অপছন্দ করতেন। তাছাড়া রাতে দেরিতে ঘুমানো শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। তাহাজ্জুদ ও ফজরের সালাত আদায়ের জন্য রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা রাখে।


আলোচক আলোচনার ধরণ: শুধু আল্লাহর সন্তষ্টি, মানুষের কল্যাণ দায়িত্ববোধ থেকে ওয়াজ করতে চান এবং কুরআন-হাদীসের পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন, বিনম্রভাবে সুন্দর ও শুদ্ধ ভাষায় আলোচনা করতে এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন— এমন দায়িত্বশীল বিচক্ষণ আলেমগণকেই কেবল মাহফিলে আলোচনা পেশ করার আহ্বান করা উচিত ওয়াজের নামে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর অযাচিত সমালোচনা, দৃষ্টিকটু আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি করা, অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি, বানোয়াট-ভিত্তিহীন উক্তি ও মন্তব্য ওয়াজ মাহফিলের গাম্ভীর্য এবং সৌন্দর্য বিনষ্ট করে আলোচনা হওয়া উচিত সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ও গঠনমূলক। যা আগে থেকে নির্ধারণ করে নিতে পারলে ভালো হবে।


প্রশ্নোত্তর সেশন ও কুইজ প্রতিযোগিতা: ওয়াজ মাহফিলে শুধু বক্তা বক্তব্য দিলেন আর শ্রোতারা শোনলেন বা সায় দিলেন, এতে শ্রোতাদের অংশগ্রহণ পুরোপুরি নিশ্চিত হয় না। সেজন্য আলোচনা শেষে


শ্রোতাদের মনের জিজ্ঞাসাগুলো তুলে আনতে প্রশ্নের উত্তরের সেশন থাকলে মাহফিল অনেক বেশি প্রাণবন্ত হবে। অবশ্য প্রশ্নগুলো আগে থেকে সংগ্রহ করে উত্তরদাতা দেখে প্রস্তুতি নিয়ে নিলে সেটা হবে অনেক বেশি অর্থবহ ও নির্ভুল। আর সবশেষে শ্রোতারা কতোটা শিখতে বা জানতে পারলেন সেটা পরখ করার জন্য উপস্থাপিত বক্তব্য থেকে শ্রোতাদের প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর দাতাকে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। এতে মাহফিল আরো বেশি উপভোগ্য হতে পারে।


আয়োজকদের দায়িত্ব:


·        স্থানীয় আয়োজকদেরকে মাহফিলের প্যান্ডেল প্রস্তুত, প্রচারণা, স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে শৃঙ্খলা রক্ষা সার্বিক বিষয়ে বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে


·        মাহফিলের মূল উদ্দেশ্যে যেন ব্যাঘাত না ঘটে, বক্তা নির্বাচন থেকে নিয়ে সব কিছুতে সে ব্যাপারে তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।


·        ওয়াজ মাহফিলে যেন ইসলামের সুহমান দাওয়াহর আবহ থাকে। মাহফিল যেন প্রদর্শনপ্রিয়তা, বা লৌকিকতা বা এ-জাতীয় কোনো মন্দ কিছুর প্লাটফর্ম না হয়— সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।


·        রাস্তায় দাড়িয়ে কিংবা গাড়ি থামিয়ে ডোনেশান কালেকশন করার মতো অপমানকর এবং বিরক্তিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।


·        ডোনেশান কালেকশনের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব হালাল উপার্জনকারীদের ডোনেশন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।


আলোচকদের জ্ঞাতব্য:


·        শুধু দীন প্রচারের দায়িত্ববোধ থেকেই মাহফিলে আলোচনা করবেন


·        কুরআন-হাদীস সুন্দর উপদেশমালাকে প্রজ্ঞার সাথে পেশ করে ওয়াজ করবেন মনগড়া কোনো কথা বা বেফাঁস কোনো মন্তব্য করবেন না


·        কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ করে কোনো আলোচনা করবেন না


·        মাহফিলে আলোচনা করবেন অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে পরিকল্পিতভাবে লোক হাসানো, কৌতুক করা কিংবা অসুন্দর কোনো অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলবেন না


·        যথাসম্ভব শ্রোতাদের প্রতি সম্মান বজায় রেখে বিনয়ের সাথে আলোকপাত করবেনশ্রোতাদের মনযোগ আকর্ষণ কিংবা সম্বোধন করতে গিয়ে ধমকের সুরে কোনো কথা বলবেন না।


·        মাহফিলে রাজনৈতিক বা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন না


·        রাষ্ট্র ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্ন হতে পারে এমন আলোচনা থেকে বিরত থাকবেন।


·        মাহফিলের আবেদন ফরম তৈরি করে নিতে পারেন। যাতে আদর্শ ওয়াজ মাহফিলের জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা উল্লেখ থাকবে।


প্রশাসনের অনুমোদন ও স্বচ্ছতা: ওয়াজ মাহফিলের লক্ষ্যই যেখানে নীতি-নৈতিকতার দীক্ষা দেওয়া, সেখানে মাহফিল করতে গিয়ে যেন কোনো প্রকার অসততা বা অনৈতিকতার আশ্রয় নেওয়া না হয়— সেদিকে খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য। স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করে/অনুমোদন নিয়ে মাহফিল আয়োজন করা সুশৃঙ্খল মাহফিলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য


বিদ্যুত ও মাইকের ব্যবহার: অনেক সময় মাহফিলের বিদ্যুত সরাসরি মেইন লাইন থেকে টানা হয়, যা অনুচিত কাজ। প্রয়োজনে আশপাশের কোনো বাসা কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে (নিরাপত্তা ও ধারণ ক্ষমতা নিশ্চিত করে) সংশ্লিষ্টদের অনুমতি ও বিল পরিশোধ সাপেক্ষে বিদ্যুত নেওয়া যেতে পারে।


মাহফিলের মাইক অনেক বেশি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত স্থাপন করার দ্বারা যদি অন্যের ধর্মের মানুষের বিরক্তি কিংবা কোনো রোগী বা কারো কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নয়। কারণ কাউকে ওয়াজ শুনতে বাধ্য করা, কিংবা সাধারণ জীবন-যাত্রা ব্যহত করা ও কষ্ট দেওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।


প্রচারণা নীতিমালা:


·        মাহফিলের ব্যানার বা পোস্টারের লেখা যেন বিশুদ্ধ থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।


·        পোস্টার বা ব্যানারে কোনো আলোচকের পরিচয়-পদবী লিখতে গিয়ে ভুল ও অতিরঞ্জন করা চরম অন্যায়।


·        উপস্থাপক কোনো আলোচকের পরিচয় উল্লেখ করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি অতিরঞ্জন ও অত্যুক্তি করবেন না


·        মাহফিলস্থল একান্ত আশপাশের এলাকার বাইরে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত মাইক লাগানো অনুচিত কাজ মাহফিলস্থলের আশেপাশে বসবাসকারী কারো যেন কষ্টের কারণ না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে


·        মাহফিলের আলোচনা ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্লাটফরমে প্রচার করার জন্য নিজস্ব বা নির্ভরযোগ্য মিডিয়া থাকলে ভালো অন্য কোনো ইউটিউবার, ফেসবুকার বা মিডিয়ার ক্যামেরা অনুমোদনের আগে তাদের চ্যানেল পেইজ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে দায়িত্বশীলতার বিষয়টি নিশ্চিত হলেই কেবল মাহফিল রেকর্ডের অনুমতি প্রদান করতে হবে যারা মাহফিলের ভিডিও ধারণ করে ভিউয়ার বাড়ানোর জন্য দৃষ্টিকটু, মিথ্যা ও আপত্তিকর থাম্বনেইল কিংবা শিরোনাম দিয়ে থাকে তাদের কোনো অবস্থাতেই মাহফিল রেকর্ডের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। উত্তম হয় মাহফিলের আগে থেকে তাদের নিকট থেকে রেকর্ডের আবেদন গ্রহণ ও পুরো ব্যপারটি এ বিষয়ে পারদর্শী কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা।


আলোচকদের সম্মানী:


আলোচকদের উচিত দীন প্রচারের মানসিকতা নিয়ে ওয়াজ করা মাহফিলে ওয়াজ করাকে যদি অন্য দশটা পেশার মতো একটা পেশা বানানো হয় তাহলে সেই ওয়াজ দ্বারা ইসলাম মুসলমানদের খুব বেশি উপকার হবে না মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-‘তোমরা তাঁর অনুকরণ কর যে তোমাদের কাছে (সত্যর পথে আহবান করে) কোনো বিনিময় চায় না আর এমন লোকেরাই হিদায়েতপ্রাপ্ত (কুরআন, ৩৬:২০) তথাপি ওয়াজ করার পর হাদিয়া বা বিনিময় দেওয়া নেওয়া জায়েয সারা বিশ্বের প্রায় সব মুসলিম স্কলার ব্যাপারে একমত কারণ সাধারণত জাতীয় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিজের সংসার পরিবারের ব্যয়ভার বহনের জন্য পৃথক কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে গেলে দীন প্রচারের কাজে ব্যঘাত ঘটে


সেজন্য কতৃপক্ষের উচিত আলোচকের গাড়িভাড়া, পথখরচ এবং অন্যান্য খরচের পাশাপাশি সম্মানজনক হাদিয়া পেশ করা কারণ