কেন থার্টি ফার্স্ট নাইট বর্জন করব
- ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ @ ১২:০০ এএম
শায়খ আহমাদুল্লাহ
আল্লাহর দেয়া জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। যে জিনিস যত মূল্যবান, তার ব্যবহার-প্রক্রিয়াও তত গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যবান এই জীবনের সময়গুলো অবহেলায় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আল্লাহর দেয়া জীবন ও সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ব্যয় করা শরীয়তের নির্দেশনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমরা আমাদের মূল্যবান এই জীবনকে এমন সব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবে খরচ করি, যার ভেতর না আছে দুনিয়ার কল্যাণ, না আছে পরকালের মুক্তি। এমন একটি অনর্থক, শরীয়া-বিবর্জিত উৎসবের নাম থার্টি ফার্স্ট নাইট। খ্রিষ্টীয় বছরের শেষ দিনটিতে দুনিয়া জুড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এই উৎসব করা হয়। দিন যত যাচ্ছে, থার্টি ফার্স্ট নাইটের উন্মাদনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এর অপকারিতা ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের ইতিহাস
প্রাচীনকালে ইরানের প্রকৃতিপূজারীরা মনে করত—বছরের প্রথম দিন আনন্দ-ফূর্তিতে কাটালে সারা বছর ভালো থাকা যাবে। সেই উদ্দেশ্যে বছরের শুরুতে তারা নানা রকম উৎসব করত এবং বিশেষ উপাদেয় খাবার ভক্ষণ করত। কালে কালে এই বিশ্বাস খ্রিষ্টানদের ভেতর অনুপ্রবেশ করে। খ্রিষ্টানরা তাদের বর্ষপঞ্জির একত্রিশ ডিসেম্বর রাতকে উৎসবের জন্য বেছে নেয়। এই রাতকে বলা হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে এই দিনটি সাধু সিলভেস্টারের দিবস হিসেবে পরিচিত। এই রাতে বিশ্বের বহু দেশ, বিশেষ করে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশের নাগরিকগণ নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে স্বজনদের সাথে মিলিত হন, নাচ-গান, আনন্দ-ফূর্তি ও মদপান করেন এবং আতশবাজি ফোটান। কতক খ্রিষ্টান গভীর রাতে বিশেষ প্রার্থনা-অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রচারণায় খ্রিষ্টীয় নববর্ষের এই অপসংস্কৃতি আজ আমাদের বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের গোড়ার ইতিহাস থেকে আমরা জানলাম—এর সঙ্গে প্রকৃতিপূজা এবং কুসংস্কারের নিবিড় যোগাযোগ আছে। বছরের প্রথম দিন আনন্দ-ফূর্তি করলে সারা বছর ভালো থাকা যাবে, এরচেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে! অথচ বর্তমান বাংলাদেশে যারা এই উৎসবের প্রবক্তা, সকলেই তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্ক। এদের কাছে ইসলাম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্ম অথচ নিজেরা প্রবৃত্তিপূজার নামে যা করে, প্রায় সবই অযৌক্তক, অহেতুক এবং কুসংস্কারে ভরপুর।
থার্টি ফার্স্ট নাইট সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
কোনো আচার-অনুষ্ঠানকে ইবাদত গণ্য করতে হলে কুরআন-হাদীসের দলিল অথবা সাহাবীদের আমলের প্রামাণ্যতার প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পক্ষে কুরআন-হাদীস এবং সাহাবীদের আমলের কোনো দলিল নেই। এতে বোঝা যায়, থার্টি ফার্স্ট নাইট কোনো ইবাদতধর্মী উৎসব না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন—সব কাজ কেন ইবাদত হিসেবেই করতে হবে! কিছু কিছু কাজ তো সামাজিকভাবেও হতে পারে! হ্যাঁ, কথা ঠিক। আমরা যাকিছু করি, সব ইবাদত না। আমরা এমন অনেক কিছু করি, যেগুলো ইবাদতের বাইরের জাগতিক এবং সামাজিক কাজ। যেমন : আমরা নৌভ্রমণ করি, সাইকেল চালাই, ফুলের বাগান করি। এগুলো জাগতিক কাজ। জাগতিক কাজ তখনই বৈধ হবে—যখন কাজটির মাধ্যমে শরীয়ার বিধান লঙ্ঘন এবং বান্দার হক ক্ষতিগ্রস্ত না হবে।
এখন আমরা দেখব—থার্টি ফার্স্ট নাইটের মধ্যে এই দুটি শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে কি না। প্রথমত, থার্টি ফার্স্ট নাইট এমন এক পৌত্তলিক বিশ্বাস থেকে উৎসারিত, যা মুসলিম বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত। বছরের প্রথম দিন ভালো কাটলে সারা বছর ভালো থাকা যায়—এটা ইসলামী বিশ্বাস নয়। দ্বিতীয়ত, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের মাধ্যমে যেভাবে সৃষ্টির হক নষ্ট করা হয়, ইসলাম তো বটেই, কোনো সভ্য মানুষও তা সমর্থন করতে পারে না। এখন আমরা দেখব থার্টি ফার্স্ট নাইটের মাধ্যমে কীভাবে নাগরিক শান্তি বিনষ্ট ও সৃষ্টির হক নষ্ট করা হয়।
থার্টি ফার্স্ট নাইটের সামাজিক ক্ষতি
থার্টি ফার্স্ট নাইটের কোনো ভালো দিক খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপরীতে এর অসংখ্য নেতিবাচক দিক, যা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, চোখকান খোলা রাখলেই খুঁজে পাবেন।
এক. অপচয় : প্রবৃত্তিগত যত উৎসব পৃথিবীতে চালু আছে, সবগুলোর ভেতর আছে অপচয়ের ক্ষতি। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষ্যে ফানুস ওড়ানো হয়, আতশবাজি ফোটানো হয়, সাউন্ডবক্স বাজানো হয়, পান করা হয় গ্যালন গ্যালন মদ। এর পেছনে যুবসমাজ অঢেল অর্থ ব্যয় করে থাকে। এগুলো অর্থের বিপুল অপচয় ছাড়া কিছু নয়। আল্লাহ কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কোনো বিবেকবান মানুষ অর্থ খরচ করে শয়তানের ভাই উপাধীতে ভূষিত হতে পারে না। অথচ যে রাতে আমাদের যুবকেরা ডিজে পার্টি ইত্যাদির পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, সেই রাতেই, ডিসেম্বরের কনকনে শীতে উত্তরবঙ্গের লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ ঠান্ডায় কষ্ট পায়।
দুই. স্বাস্থ্যবিপর্যয় : থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকার মতো ঘনবসতীপূর্ণ শহরে বিকট শব্দে সাউন্ডবক্স এবং আতশবাজি ফোটানো হয়। এই শহরের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বৃদ্ধ-শিশু ও অসুস্থরা থাকে। বিকট শব্দদূষণে যেখানে সাধারণ সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেখানে এই অসুস্থ এবং বৃদ্ধ-শিশুদের কী অবস্থা হয় একটু কল্পনা করুন। যাদের মধ্যে ন্যূনতম বিবেক ও মূল্যবোধ আছে, তারা কখনো উৎসবের নামে এই ধরনের অনাচার করতে পারে না।
তিন. বিপর্যস্ত প্রকৃতি : থার্টি ফার্স্ট নাইটের আতশবাজি শুধু মানুষের স্বাস্থ্যই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে না, এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকৃতির শোভা পাখিদের জীবনও বিপন্ন হয়ে ওঠে। গাছপালার অপ্রতুলতায় ঢাকা শহরে পাখির বসবাস কম। তার উপর বছরের প্রথম দিনের ভোরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আতশবাজিতে ঝলসে যাওয়া পাখিদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। যে উৎসবে পাখিদের জীবন বিপন্ন হয়, সেটা কোনো উৎসবই হতে পারে না।
চার. নিরাপত্তা-ঝুঁকি : থার্টি ফার্স্ট নাইটের ফানুসের আগুনে প্রতি বছরই দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে ফানুস-সৃষ্ট আগুনে সর্বস্ব দিয়ে গড়ে তোলা একজন দরিদ্র নারীর প্লাস্টিক কারখানা সম্পূর্ণ ভস্ম হয়ে যায়। একই বছর উল্লাসকারীদের পটকার আওয়াজ একটি নিষ্পাপ শিশুর জীবন কেড়ে নেয়। আমরা সকলেই চাই, বছরের প্রথম ভোরটা ভালো খবর দিয়ে শুরু হোক। অথচ এই অবান্তর, অহেতুক উন্মাদনার কারণে প্রত্যেকবার বছরের প্রথম দিনটা দুঃসংবাদ দিয়ে শুরু হয়। এতকিছুর পরও আমাদের বিবেক জাগ্রত হয় না। আমাদের টনক নড়ে না।
পাঁচ. ভোগবাদী প্রজন্মের বেড়ে ওঠা : থার্টি ফার্স্ট নাইট পশুর মতো একটি ভোগবাদী প্রজন্ম তৈরি করছে। খাওয়া, মলত্যাগ করা, অতঃপর মরে যাওয়া ছাড়া পশুর জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। খারাপ শোনা গেলেও আমাদের জীবনটা পশুর মতোই হয়ে গেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তখনই অর্জিত হবে, যখন সে অপরের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। অথচ আমরা চরম আত্মকেন্দ্রীক ও ভোগবাদী হয়ে গেছি।
ইসলাম আমাদেরকে দুটি উৎসব দিয়েছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতরে আমরা ঈদগাহে যাওয়ার আগে গরিবের হক সদকাতুল ফিতর আদায় করি। আর ঈদুল আযহাতে কুরবানীর মাংসের একটা অংশ গরিবের হাতে তুলে দেয়ার পরেই নিজের ভাগ ঘরে তুলি। ইসলামের দুটি উৎসবেই আছে ভোগের সাথে ত্যাগের শিক্ষা। ইসলাম শুধু ত্যাগ করতেও বলে না, বলে না শুধু ভোগ করতেও। ইসলাম একটি মধ্যপন্থী সমন্বিত জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলামের দুটি উৎসবের বাইরে আমাদের সমাজে প্রচলিত সকল উৎসবের দিকে দৃষ্টিপাত করুন, সবগুলোর উদ্দেশ্য ভোগ। কোথাও আপনি ত্যাগের মহিমা দেখতে পাবেন না।
আমরা কেন থার্টি ফার্স্ট নাইট বর্জন করব
এক. থার্টি ফার্স্ট নাইট মুসলিম কালচার নয়, এটি এসেছে অগ্নিপূজকদের কাছ থেকে। এর ভেতর অগ্নিপূজকদের শিরকি বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। এ কারণে এই উৎসবে অংশ নেয়া মুসলমানদের জন্য বৈধ নয়। রসুল সা. বলেছেন : যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
দুই. ইসলাম আমাদের জন্য যে সংস্কৃতি দিয়েছে, তা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থাকতে কেন আমরা বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করব? আমদানি তো তারা করবে, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নেই। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমাদের ঈদ আছে, ওলিমা-আকীকা আছে। এ দেশের ওয়াজ-মাহফিল স্থানীয় মুসলিম সংস্কৃতির বড় উদাহরণ। এরপরও যখন আমরা সংস্কৃতির জন্য অন্যের দ্বারস্থ হই, বোঝা যায়, জ্ঞান, চিন্তা ও বোধের জায়গায় আমরা কতটা দেউলিয়া! অমুসলিমরা কি নামে-বেনামে আমাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে?
তিন. থার্টি ফার্স্ট নাইট উন্মাদনা ও ভোগবাদিতাকে উৎসাহিত করে, যা ইসলামের দর্শন ও চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা কখনোই চাই না—আমাদের সন্তানেরা ভোগাবদী হয়ে বেড়ে উঠুক। একজন মানুষকে তখনই প্রকৃত মানুষ বলা যাবে, যখন সে ভোগের পাশাপাশি অপরের জন্য ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দেয়ার মানসিকতা অর্জন করবে।
ইসলাম শারীরিক আনন্দ-ফূর্তির চেয়ে আত্মার আনন্দকে গুরুত্ব দেয়। শারীরিক আনন্দের চেয়ে আত্মার আনন্দ অনেক বেশি মহিমাময়। রসুল সা. বলেছেন : অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।
নতুন বছরের আহ্বান
নতুন বছর মানে নতুনের আগমনই শুধু নয়, নতুন বছর মানে পুরতনের বিদায়ও। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি, অথচ একটিবারও ভাবি না, আমার জীবনের পঞ্জিকা থেকে আরো একটি বছরের পাতা ঝরে গেল। আমাদের জীবন তো ভাই বরফের মতো, ক্রমাগত গলছে। জীবন থেকে গলে যাওয়া সেই মুহূর্তগুলোর জন্য কি আমাদের মন খারাপ হয়? থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমরা কি একবারও ভাবি—কবরের দিকে আমার পা আরো একধাপ এগিয়ে গেল? কবরের জন্য আমার সঞ্চয় কী? সব নতুনই আনন্দের নয়। ভোরের সূর্যোদয় কার না পছন্দ! অথচ একজন ফাঁসির আসামীর কাছে ভোরের সূর্যোদয় দুঃস্বপ্নের মতো। ফাঁসির আসামীর কাছে নতুন সূর্যোদয় মানেই মৃত্যুর কাছে আরো একটা দিন এগিয়ে যাওয়া।
আমরাও কি প্রত্যেকে ফাঁসির আসামীর মতো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি না? আল্লাহ কি জন্মের সাথে সাথে আমাদের মৃত্যু পরোয়ানা লিখে দেননি? প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে—এই আয়াত কি আমরা শুনিনি? তবে কীসের এই নববর্ষ উদযাপন! কেন এই উন্মাদনা!
নতুন বছর উদযাপনের আগে আমাদের প্রথম করণীয়—ভালো কাজগুলো অব্যাহত রাখা এবং বিগত দিনের ভুলত্রুটিগুলো শোধরানো। নতুন বছরে আমাদের জীবনে যদি পরিবর্তন না আসে, আমরা যদি একই ভুলে ডুবে থাকি, যদি আমাদের অপূর্ণতাগুলোকে পূর্ণতা দিতে না পারি, তবে আমাদের এই আচার-অনুষ্ঠান উদযাপনের কোনো সার্থকতা নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বিজাতীয় সংস্কৃতি পরিহার করার এবং ইসলামীয় কৃষ্টি-কালচার গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।