রমাদান সার্থক করার উপায়
- ০৮ মার্চ, ২০২৫ @ ১২:০০ এএম
রমাদান মহান আল্লাহর অফুরান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এটি মানবজাতির জন্য আধ্যাত্মিক উন্নয়ন, আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম সুযোগ। এই মাসের মর্যাদা ও ফযীলত উপলব্ধি করে এর প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।
যেসব কারণে এই মাসটি শ্রেষ্ঠ, তার অন্যতম কয়েকটি হলো—
কুরআন নাযিলের মাস: আল্লাহ তাআলা মুসলিম মিল্লাতের ওপর যত অনুগ্রহ দান করেছেন, কুরআনুল কারীম তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ। কুরআন যেকোনো জাতির উন্নতি ও অবনতির মাপকাঠি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন— আল্লাহ তাআলা এই কুরআনের মাধ্যমে কোনো জাতিকে উন্নতি দান করেন আর কোনো জাতির অবনতি ঘটান। (সহীহ মুসলিম-৮১৭)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই উন্নতির চাবিকাঠি দান করেছেন রমাদান মাসে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেন— রমাদান মাস, যাতে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং সত্যাসত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যকারীরূপে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। (সূরা বাকারা: আয়াত ১৮৫)
জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা এবং শয়তানকে আবদ্ধ করার মাস: রমাদানুল কারীমের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ও ফযীলত হলো, এই মাসে আল্লাহ তাআলা তিনটি বিশাল বড় ফযীলত এবং মর্যাদা রেখেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন—যখন রমাদান আসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে বন্দি করে রাখা হয়। (সহীহ মুসলিম-১০৭৯)
ক্ষমা ও মুক্তির মাস: রামাদানুল কারীম ঈমানদারের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছ থেকে ক্ষমা লাভের, জাহান্নাম থেকে নাজাত এবং মুক্তি লাভের এক বিশেষ সুযোগের মাস। আল্লাহ তাআলার দেয়া সারা বছরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অফারের মুহূর্ত হলো রমাদানুল কারীমের মুহূর্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— আল্লাহ তাআলা (রমাদানের) প্রত্যেক দিনে এবং রাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। (মুসনাদে আহমাদ-৭৪৫০)
আমলের সাওয়াব বর্ধিত করার মাস: রামাদানুল কারীম মাসে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে প্রত্যেকটি আমলের বিনিময়ে অনেক বর্ধিত দিয়ে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বনী আদমের সকল নেক আমলের বিনিময় দশগুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম। সিয়াম আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। (সহীহ মুসলিম-১১৫১)
তাকওয়ার মাস: আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমাদান দান করেছেন, আমাদেরকে মুত্তাকী বানানোর জন্য। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন— তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সূরা বাকারা: আয়াত-১৮৩)
উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা বুঝতে পারলাম, রমাদান কুরআন নাযিলের মাস, জান্নাতের দরজা উম্মুক্ত হওয়া, জাহান্নাম বন্ধ করে দেওয়া এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখার মাস, আমলের সাওয়াব বর্ধিত করার মাস। সর্বোপরি এটি তাকওয়ার মাস। এক কথায় এটি ইবাদতের উপযোগী পরিবেশ করে দেওয়ার মাস।
এই মাসের আমলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো সিয়াম। সিয়ামের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারের সময়, আরেকটি তার প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। আর সিয়াম পালনকারীর মুখের (পাকস্থলিজাত) দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও বেশি পবিত্র। (সহীহ বুখারী-৭৪৯২)
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সাওয়াবের জন্য রমাদানের সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী-৩৮, সহীহ মুসলিম-৭৬০)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন— জান্নাতে আটটি দরজা রয়েছে। তার একটি দরজার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারী ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী-৩২৫৭)
সিয়ামের মর্যাদা বোঝার জন্য আরও একটি বিষয় লক্ষ করতে পারি, তা হলো, সিয়াম ইসলামের মূল পাঁচ আরকানের একটি।
প্রত্যেক ব্যবসায়ী ব্যবসার সিজনের জন্য মুখিয়ে থাকে। ব্যবসার সিজন হাতছাড়া করতে চায় না, ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টায় কসুর করে না। তদ্রূপ রমাদান ঈমানদারদের নেকি অর্জনের সিজন। ঈমানদারদেরও উচিত রমাদানকে নেকি অর্জন ও গুনাহ মাফের সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া না করা।
রমাদান সার্থক করার জন্য কয়েকটি পরামর্শ
উপরে আমরা আলোচনা করছি, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমাদানুল কারীম এবং সিয়াম দিয়েছেন মুত্তাক্বী বানানোর জন্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের সিয়াম আমাদেরকে মুত্তাক্বী বানাচ্ছে কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সিয়ামের কোনো প্রভাব পড়ছে কি? শুধু ইফতার ও সাহরী খাওয়া এবং বড়জোর তারাবীহ আদায় করা— এই তিনটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই যদি আমার সিয়াম শেষ হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহ তাআলা যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সিয়ামের বিধান আরোপ করেছেন, আমার সিয়াম সেই উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়নি। কিছু বিষয় মেনে চলতে পারলে ইন-শা-আল্লাহ আমাদের সিয়াম সার্থক হবে।
১. হারামের সংশ্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখা: রাসূল (সা.) বলেছেন— নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকো, তাহলে তুমি মানুষের মধ্যে সবচে বড় ইবাদতগুজার হিসাবে গণ্য হবে। (সুনান তিরমিযী-২৩০৫)
আল্লাহ তাআলা সিয়ামের বিধান এজন্য আরোপ করেছেন যে, যেভাবে আমরা রমাদানের দিনের বেলা পানাহার নিজের ওপর হারাম করেছি, তদ্রূপ যেন আল্লাহ-কর্তৃক অন্যান্য সকল নিষিদ্ধ বিষয়ও হারাম জ্ঞান করে বর্জন করি। তা যদি করতে পারি, তাহলে আমার সিয়াম সার্থক। যারা সিয়াম পলন করছেন কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন নেই, তাদের কাজ-কর্মে কোনো পার্থক্য আসে না, হারামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয় না, অবৈধ উপার্জন অব্যাহত আছে, টেলিভিশনে-মোবাইলে হারাম কন্টেন্ট দেখে— তাহলে তার সিয়াম ব্যর্থ; তা নিছক উপবাস ছাড়া কিছুই নয়।
সিয়াম থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সাধারণত আমরা সবাই একান্ত নিষ্ঠা ও ইখলাসের সাথে সিয়াম পালন করি। আপনি যখন একাকী থাকেন, আপনার কাছে কেউ থাকে না, প্রচণ্ড ক্ষুধা সত্ত্বেও আপনি কিছু খান না। কেন খান না? কারণ আল্লাহ দেখছেন। যে আল্লাহর ভয়ে আপনি রমাদানের দিনের বেলা পানাহার ত্যাগ করলেন, সে আল্লাহর ভয়ে কেন অন্যান্য হারাম কাজ ত্যাগ করছেন না? আপনি যখন ফিল্ম দেখেন, মোবাইলে গান শোনেন, হারাম কন্টেন্ট দেখেন তখনও তো আল্লাহ দেখেন। তাহলে সেসব হারাম কাজ কেন করেন? সিয়াম থেকে যদি আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, এই মাসে আমাদের চরিত্র বদলে ফেলব— তাহলেই আমাদের সিয়াম পালন সার্থক হবে। আমাদের রমাদান সার্থক হবে।
২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতের সাথে আদায় করা: বিশেষ করে রমাদানের দিনগুলোতে এ ব্যাপারে বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। এর সহজ উপায় হলো আযানের সাথে সাথে মসজিদে চলে যাওয়া। নবী কারীম সা. বলেছেন— কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দাদের থেকে সালাতের হিসাব নেয়া হবে। সালাত যথাযথভাবে আদায় হয়ে থাকলে সে সফল হবে ও মুক্তি পাবে। সালাত যথাযথ আদায় না হয়ে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হবে। (সুনান নাসায়ী-৪৬৫)
মহিলারা বাসা-বাড়িতে প্রথম ওয়াক্তে, ধীরস্থিরভাবে সালাত আদায় করবেন।
৩. কুরআন তিলাওয়াত করা: রমাদান কুরআন নাযিলের মাস। কাজেই এই মাসে অধিক পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। তিলাওয়াতের সময় আয়াতের অর্থ, প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা অনুধাবনের চেষ্টা করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সিয়াম এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে পানাহার ও জৈবিক কর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ তখন তাদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে। (মুসনাদ আহমাদ ৬৬২৬, মুসতাদরাক হাকিম-২০৩৬, শুআবুল ঈমান-১৯৯৪)
৪. ইসলামী জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করা: ব্যক্তিগতভাবে এবং পরিবারকে সাথে নিয়ে ইসলামের মৌলিক জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট থাকা যেতে পারে। আমলের মাস রমাদানে এর অভ্যাস করে ফেলতে পারলে সারা বছর এর প্রভাব থাকবে ইন-শা-আল্লাহ।
৫. দোয়া এবং তাহাজ্জুদে মনোনিবেশ করা: রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন— কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন, যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহীহ বুখারী-১১৪৫)
রমাদানে আমরা সবাই সাহরী খাওয়ার জন্য ভোররাতে ঘুম থেকে উঠি। খাবার প্রস্তুত হতে যতক্ষণ লাগে, আমরা চাইলেই এর মধ্যে কয়েক রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ে ফেলতে পারি। অথচ আলস্য বশত আমরা ফযীলতপূর্ণ সময়টা অহেতুক কাটিয়ে দিই।
আমাদের এ সিয়াম তখনই উপকার বয়ে আনবে, এ সিয়াম তখনই সার্থক হবে, যদি আমরা তাকওয়ার পথে অগ্রসর হতে পারি, গাইডলাইন মেনে চলতে পারি। সুতরাং আসুন, রামাদানুল কারীমকে আমাদের জীবনের সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করি এবং এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত নেক আমলে ব্যায় করার চেষ্টা করি, বদ আমল থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কুরআন এবং সুন্নাহর প্রদর্শিত পথ এবং পদ্ধতি অনুসারে আমলের মাধ্যমে আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের আমরা চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।