নবীজি (সা.)-এর সমরজীবন ও আজকের যুদ্ধবাস্তবতা

নবীজি (সা.)-এর সমরজীবন ও আজকের যুদ্ধবাস্তবতা

শায়খ আহমাদুল্লাহ

বর্তমানে আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করছি, তা যেন এক যুদ্ধের নগরী। ভালোবাসা, মায়ামমতা উৎপাদনের চেয়ে অস্ত্র উৎপাদনে এই পৃথিবীর আগ্রহ বেশি। পান থেকে চুন খসলেই দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। এবং যুদ্ধ মানেই ধ্বংসযজ্ঞ, রক্তপাত, হাজার হাজার প্রাণহানি। 

এর চেয়েও করুণ এক সময়ে আমাদের নবীজি (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন। তখন অজ্ঞতার আঁধারে ছেয়ে গিয়েছিল গোটা দুনিয়া। হানাহানি, মারামারি, রক্তপাত, জীবন্ত কন্যা সন্তান দাফন ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। গোত্রীয় দাঙ্গা এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, মৃত্যুর আগে বাবা সন্তানকে ওসিয়ত করে যেত, প্রতিশোধ না নিয়েই আমি মারা যাচ্ছি, তুমি এর বদলা নিও। কোনো একটি ঘটনার সূত্রে শুরু হওয়া যুদ্ধ প্রজন্মের পর প্রজন্ম অব্যাহত থাকত। ভালোবাসা দিয়ে সেই অসুস্থ সমাজকে রসুল (সা.) শান্তির সমাজে পরিণত করেছিলেন।

মহান আল্লাহ রসুলকে (সা.) জগৎসমূহের রহমত উপাধিতে ভূষিত করেছেন [আম্বিয়া ১০৭]। সত্যিই তিনি ছিলেন রহমতের আধার। ভালোবাসা দিয়ে তিনি পৃথিবীর খোলনলচে বদলে দিয়েছেন। অবশ্য এই পরিবর্তন ঘটাতে গিয়ে তাকে সাতাশটি যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। কিন্তু সেই যুদ্ধগুলোও আমাদেরকে মানবিকতা শিক্ষা দেয়। নবীজির (সা.) যুদ্ধগুলোর বেশিরভাগই আক্রমণাত্মক ছিল না, ছিল আত্মরক্ষামূলক, প্রতিপক্ষের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধগুলোয় অংশ না নিলে মুসলমানরা অস্তিত্বের সংকটে পড়ত। 

আমরা জানি, হিজরতের পর মদিনায় ইসলাম একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো লাভ করে। তখন মুসলিমদের আত্মরক্ষা, কৌশলগত প্রতিরোধ ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইসলামের প্রথম তিনটি বড় যুদ্ধ—বদর, ওহুদ, খন্দক—সবগুলোই সংঘটিত হয়েছে মদিনা কিংবা মদিনার উপকণ্ঠে বা অদূরে। যুদ্ধের ভৌগলিক অবস্থানই বলে দেয়, যুদ্ধগুলো করতে মুসলমনরা বাধ্য ছিলেন। নয়তো তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। মূলত যুদ্ধ যখন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে, প্রতিরোধ না করে তখন আর কোনো উপায় থাকে না। একই কথা মক্কা বিজয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মক্কা বিজয় নবীজির (সা.) সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব থেকে সংঘটিত হয়নি। বরং প্রতিপক্ষের শান্তিচুক্তি ভঙ্গের কারণেই মক্কায় অভিযান পরিচালিত হয়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, এই বিরাট অভিযান পরিচালিত হয়েছে প্রায় রক্তপাতহীন অবস্থায়। অথচ মুশরিকদের অকল্পনীয় নির্যাতনের মুখে এই মক্কা থেকে নবীজি (সা.) একদা হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্য কোনো সেনাপতি হলে এই অভিযানে রক্তের নদী বয়ে যেত, লাশের পাহাড় রচিত হতো, নিহতের স্বজনদের আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। কিন্তু রসুল (সা.) কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি। তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ক্ষমাই সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ। 

নবীজির (সা.) জীবনে সংঘটিত সাতাশটি যুদ্ধে সর্বসাকুল্যে চারশ মানুষ মারা গেছে। নবীজি (সা.)-এর জীবনের লক্ষ্য যে যুদ্ধ ছিল না, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠা ছিল তার জীবনের লক্ষ্য, উপরের ‘চারশ’ সংখ্যাটাই তার বড় প্রমাণ। আবার নিহত এই মানুষগুলো বেসামরিক নাগরিক ছিল না। বরং অস্ত্র হাতে লড়াই করতে এসে তারা মারা গিয়েছিল। বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। অবিশ্বাস্য এই কারণে যে, আজকের পৃথিবীর কথিত শান্তিবাদীদের একটি বোমার আঘাতেই চারশর বেশি মানুষ মারা যায়। তাও নারী-শিশু সহ বেসামরিক নাগরিক। শুধু তাই নয়, অনেক দেশ বেছে বেছে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে বোমা মারে। অথচ রসুল (সা.)-এর সমরনীতি ছিল এমন : যুদ্ধে নারী, শিশু, বৃদ্ধদের আঘাত করা যাবে না। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আক্রমণ করা যাবে না। বৃক্ষ ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট করা যাবে না। উপাসনালয়ে থাকা লোকদের হত্যা করা যাবে না। শুধু তাই নয়, নিহতের শরীর বিকৃত করতে তিনি নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যুদ্ধের ময়দানে কাউকে হত্যা করতে হলে তার ওপর যেন অনুগ্রহ করা হয়, অমানবিক আচরণ যেন করা না হয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে হালাল প্রাণী জবাই করে আমাদের খেতে হয়। কিন্তু জবাইয়ের সময় সেই প্রাণীর ওপর দয়া করার নির্দেশ তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন। 

নবীজির (সা.) উপর্যুক্ত সমরনীতি এই বার্তা দেয়, প্রতিপক্ষের উস্কানি, অপতৎপরতা এবং আক্রমণের মুখে কখনো কখনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অনিবার্যতা আমাদের সামনে আসতে পারে, কিন্তু সেই যুদ্ধ যেন হয় মানবিক। সেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি যেন হয় কম, সেই যুদ্ধে অহেতুক নিষ্ঠুরতা যেন প্রদর্শিত না হয়। 

বর্তমান পৃথিবী নবীজি (সা.)-এর এই মানবিক সমরনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। গত শতাব্দীতে সংঘটিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দুটি মহাযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গেছে ৭০-৮০ মিলিয়ন মানুষ। নিহতের তিনভাগের দুই ভাগই বেসামরিক নাগরিক। মানুষ নিজের ক্ষমতাকে সুগঠিত করতে এবং নিজের সাম্রাজ্যকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে তৈরি করছে ক্ষেপনাস্ত্র, মিসাইল, পারমাণবিক বোমা। সবকিছুই একটি শান্তিকামী পৃথিবীর জন্য হুমকি। যুদ্ধপ্রবণ এই সময়ে আমরা যদি রসুল (সা.)-এর আদর্শ ও সমর-নীতি অনুসরণ করি, তবে এই অশান্ত পৃথিবীর আগুন অনেকটাই নিভিয়ে ফেলা সম্ভব। 

গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ