যুদ্ধের ময়দানেও মানবিক ছিলেন যিনি

যুদ্ধের ময়দানেও মানবিক ছিলেন যিনি

শায়খ আহমাদুল্লাহ

দিন যত যাচ্ছে সর্বব্যাপী ভয়ংকর যুদ্ধ পৃথিবীতে ততই ছড়িয়ে পড়ছে। যুদ্ধ দেখে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হচ্ছি, আতঙ্কিত হচ্ছি। এই বিপুল বৈরী পরিবেশের মাঝেও যার কথা আমাদের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, তিনি আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এই যুদ্ধবাজ সময়ের সঙ্গে যদি আমরা নবীজি (সা.)-এর সময়ের তুলনা করি, বুঝতে পারব এই সময়টা কত বেশি বর্বর, অমানবিক ও নিষ্ঠুর। নবীজি (সা.)-এর সময়কার পৃথিবীতে এখনকার তুলনায় যুদ্ধবিগ্রহ অনেক বেশি ছিল। তবে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। নবীজি (সা.) জীবদ্দশায় ২৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এর কোনোটিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, কোনোটিতে শুধু অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে প্রায় সব যুদ্ধই ছিল প্রতিরক্ষামূলক। যদিও কিছু কিছু যুদ্ধের ইতিহাস পড়লে মনে হতে পারে, এগুলো আক্রমণাত্মক যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধগুলোর প্রেক্ষাপট গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, সেগুলোও ছিল প্রতিরক্ষামূলক। প্রতিপক্ষ হয়তো গোপনে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিংবা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করছে, এরকম পরিস্থিতিতে রসুল (সা.) বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেছেন। যেমন বদরের যুদ্ধের কথা বলা যায়। এই যুদ্ধে মুসলমানরা আগে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হয়েছিল। তবে এই উপস্থিতির কারণ যুদ্ধ ছিল না, ছিল অধিকার আদায়। হিজরতের সময় মুসলমানদের সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছিল মক্কাবাসী। তারা মুসলমানদের সম্পদ দিয়ে বাণিজ্য করত। সেই লুণ্ঠিত সম্পদ উদ্ধার করার জন্য মুসলমানরা বদরে গিয়েছিল। তাদের কোনো সামরিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু মুসলমানদের এই উপস্থিতির কারণে মক্কাবাসী সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে বদরে উপস্থিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের যুদ্ধে জড়াতে হয়।

আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধের প্রধান কারণ সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব। কোথাও আমার কথা ঠিকমতো শোনা হচ্ছে না, কোথাও আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করা হচ্ছে, কোথাও আমার মোড়লগিরি খর্ব হচ্ছে, ব্যস সেখানে নানা ছুতোয় আক্রমণ করতে হবে।

আমরা বলি, মব জাস্টিস বা আইন হাতে তুলে নেওয়া ভালো কাজ না। বিষয়টি আমরা সিরাতের আয়না দিয়ে দেখতে চাই। ১৪০০ বছর আগের সেই সময়টাতে কেউ কোনো অপরাধ করলে সাহাবিরা নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অনুমতি চাইতেন। কিন্তু নবীজি (সা.) সচরাচর কাউকে অনুমতি দিতেন না। হোক সেটা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ। আজ যারা আমাদের সকালবিকাল মানবাধিকারের সবক দেয়, সেই তারা সাজানো অভিযোগ এনে দুর্বল প্রতিপক্ষ দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বোম্বিং করে লাখ লাখ মানুষ, স্থাপনা, সাজানো সংসার ধ্বংস করে। পরে দেখা যায়, যে অভিযোগে দেশটিকে ধ্বংস করা হলো, সেই অভিযোগ মিথ্যা। কিন্তু এত বড় অপকর্ম করার পরও সেই সভ্যদের মুখ থেকে কখনো ‘স্যরি’ শব্দটি শুনবেন না। এরপরও আমাদের বলতে হবে, আজকের পৃথিবী সভ্য পৃথিবী!

বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে নবীজি (সা.)-কে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কিন্তু সেসব যুদ্ধে তিনি ছিলেন অনেক বেশি মানবিক, অধিকারসচেতন এবং ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। হাদিসে এসেছে, রসুল (সা.) লাশ বিকৃত করতে নিষেধ করেছেন। যত বড় শত্রুই হোক, তার লাশের অঙ্গহানি করে আনন্দ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জাহিলি যুগে প্রতিপক্ষের লাশের নাক-কান ইত্যাদি কেটে পৈশাচিক আনন্দ করা হতো। নবীজি (সা.) কঠিন ভাষায় এটা নিষেধ করেছেন। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে মক্কার বাঘা বাঘা নেতা মারা যায়। মক্কার জীবনে যারা মুসলমানদের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন চালিয়েছে, জন্মভূমি থেকে বের করে দিয়েছে, সেই তারা যখন মুসলমানদের হাতে ধরাশায়ী হলো, কোনো সাহাবি তাদের লাশের সঙ্গে অমানবিক, অবমাননাকর আচরণ করেননি।

আজকের সভ্য পৃথিবী তিনটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন। ১. পরিবেশ ২. নারী অধিকার ৩. শিশু অধিকার।  দুঃখের বিষয়, সভ্য পৃথিবীর অমানবিক যুদ্ধে এই তিনটি জিনিসই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বোমায় লাখ লাখ মানুষ তো মারা যায়ই, আক্রান্ত এলাকার পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, বোমা বিস্ফোরণের অনেক বছর পরও জন্ম নেওয়া শিশু বিকলাঙ্গ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হতো। এতই ছিল এর তেজস্ক্রিয়া। এরপরও আজকের পৃথিবী নাকি নারীবান্ধব! আজকের পৃথিবী নাকি শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী! বাস্তবতা হলো, নারী এবং শিশুদের সত্যিকারের অধিকার দিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। স্বাভাবিক সময়ে তো বটেই, যুদ্ধক্ষেত্রেও নবীজি (সা.) এবং খলিফা আবু বকর (রা.) নারী-শিশুদের ওপর আঘাত হানতে এবং গাছপালা ও ফসল নষ্ট করতে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন।

গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ