যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মাদরাসা ছাত্রদের প্রস্তুতি
- ১২ জুলাই, ২০২৫ @ ১২:০০ এএম
শায়খ আহমাদুল্লাহ
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ বহুমুখী সংকট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। একদিকে আধুনিকতার নামে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্র। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আলেম সমাজই উম্মাহর পথপ্রদর্শক। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—সিপাহী বিপ্লব ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সমাজ সংস্কারের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে আলেম সমাজই উম্মাহর পথনির্দেশক ও সমাজের নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছে।
আলেম সমাজকে সাধারণ মানুষ যতটা বিশ্বাস করে, অন্য কোনো শ্রেণির মানুষের প্রতি তাদের ততটা আস্থা কিংবা বিশ্বাস নেই। মানুষের এই গভীর আস্থা ও নির্ভরতা এক বিরাট সম্ভাবনা। এই ইতিবাচক দিকটিকে কাজে লাগিয়ে আলেমগণ সমাজ বদলে দিতে পারেন। তবে, আজকের বৈচিত্র্যময় ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে এই নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী যোগ্যতা ও পূর্ণ প্রস্তুতি। ফলে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বহুমুখী যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। নিজেকে গড়ে তুলতে হবে যুগসচেতন, মুখলিস, নিষ্ঠাবান, দক্ষ ও চরিত্রবান ব্যক্তি হিসেবে—যারা নবীজি (সা.)-এর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অধুনা পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবে। এই প্রস্তুতির জন্য কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য।
বিশুদ্ধ নিয়ত : সকল সফলতার মূল ভিত্তি হলো নিয়ত। একজন মাদরাসা ছাত্রের ইলমের যাত্রার সূচনাও হতে হবে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার খাঁটি নিয়ত দিয়ে। খ্যাতি, জনপ্রিয়তা, ধন-সম্পদের মোহ, মানুষের বাহবা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রসিদ্ধি লাভ করার বাসনা নিয়তের একনিষ্ঠতাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়।
দুঃখজনক হলো—অনেক ছাত্র নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ বা পরিবারের চাপে মাদরাসায় পড়ে থাকে। অনেকে আবার আলেম হওয়াকে নিছক রুটি-রুজির একটি মাধ্যম হিসেবেও গণ্য করে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই ভেজালযুক্ত উদ্দেশ্য নিয়ে অর্জিত জ্ঞান উম্মাহর জন্য কল্যাণকর না হয়ে বরং ফিতনার কারণ হতে পারে। তাই পড়াশোনার সূচনাতেই নিয়ত পরিশুদ্ধকরণ, হীন ও তুচ্ছ চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর দ্বীনের সেবা করার মানসিকতা লালন ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইলম অর্জনের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
একাডেমিক শিক্ষার মজবুত ভিত্তি : একজন আদর্শ ছাত্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য গুণ হলো দৃঢ় একাডেমিক ভিত্তি তথা ইলমের গভীরতা। পাঠ্যপুস্তকে পূর্ণ দক্ষতা এবং দ্বীনের প্রতিটি বিষয়কে গভীরভাবে আত্মস্থ করাই হলো সেই ভিত্তি, যার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হবে। একটি দুর্বল ভিত্তির ওপর যেমন সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করা যায় না, তেমনি অগভীর ও ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়াও অসম্ভব।
অনেক তরুণ দ্বীনের সেবা করতে আগ্রহী, কিন্তু দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোও তাদের কাছে অস্পষ্ট। টুকটাক কুরআন-হাদিস শিখে প্রচারের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই প্রচারের মানসিকতা প্রশংসনীয় হলেও, দ্বীনের পরিপূর্ণ ইলম অর্জন না করে দাওয়াতি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়া লাভের চেয়ে ক্ষতির দিক বেশি। তাই কুরআন-হাদিস, তাফসির, ফিকহ ও ইসলামের ইতিহাসের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে পাণ্ডিত্য অর্জন করা অপরিহার্য। বছরের পর বছর বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা ছাড়া এ যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
ইলম অনুযায়ী আমল : জ্ঞান যদি আমলে পরিণত না হয়, তবে তা একটি প্রাণহীন দেহের মতো। একজন মাদরাসার ছাত্র কুরআন ও সুন্নাহর বাস্তব প্রতিচ্ছবি। কাজেই তার প্রতিটি কাজ, কথা ও আচরণে নবীজি (সা.)-এর আদর্শের প্রতিফলন থাকতে হবে। যে আয়াত বা হাদিস আমি জানলাম, সে অনুযায়ী আমল করা আমার প্রথম দায়িত্ব। আমার অর্জিত ইলম যদি আমার নিজেকে প্রভাবিত করতে না পারে, তাহলে অন্যকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? এ কারণেই আমলহীন আলেম যত বড় পণ্ডিতই হোক না কেন, তার দ্বারা দ্বীনের প্রকৃত উপকার সাধিত হয় না।
আজকাল তাহাজ্জুদের জায়নামাজে বসে অশ্রুপাত, নফল রোজার পাবন্দি এবং ছোট ছোট গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার অভ্যাস ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অথচ তাকওয়া ও আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কই হলো দাঈর মূল শক্তি। আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন একজন ছাত্র নিছক তথাকথিত আলেম হতে পারে, কিন্তু উম্মাহর ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তোলার মতো দরদী দাঈ কখনো হতে পারে না। পূর্বসূরী মুসলমান যতটা আল্লাহভীরু পরহেজগার ছিল বর্তমান মুসলমান তা থেকে আজ বহু দূরে। মুসলমানদের হারানো সেই ঈমানী দৃঢ়তা আবারো ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন তালিবে ইলম বা তরুণ আলেমকে তালিকা করতে হবে যে, কুরআন ও হাদিসের যেসব করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ের জ্ঞান সে অর্জন করেছে তার কোনটিকে আমলে পরিণত করতে পেরেছে, আর কোনটি এখনো আমলে আসেনি।
জাগতিক বিষয়ে সম্যক ধারণা : উম্মাহর কাছে কাঙ্ক্ষিত দাওয়াহ পৌঁছাতে হলে যুগের ভাষা রপ্ত করা অপরিহার্য। কুরআন-হাদিস ও ইসলমি ইতিহাসের ওপর গভীর পাণ্ডিত্বের পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞনের ওপর সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। পৃথিবীকে জানার জানালা হলো ইংরেজি ভাষা। আজকের পৃথিবীকে জানতে হলে জাগতিক সাধারণ জ্ঞান এবং ইংরেজি ভাষার মতো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যমে পারঙ্গমতা অর্জনের বিকল্প নেই। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা প্রায় অসম্ভব।
শুধু ভাষা নয়, আধুনিক বিভিন্ন মতবাদ যেমন—মডার্নিজম, সেক্যুলারিজম, লিবারেলিজম, ফেমিনিজম ইত্যাদি সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য। এসব মতবাদের নামে মুসলিম জাতিকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেসব চক্রান্ত সম্পর্কে না জানলে তার মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সুতরাং, আরবি ভাষায় দক্ষতা, কুরআন-সুন্নাহর গভীর পাণ্ডিত্য এবং ইসলামি ইতিহাসের ওপর ব্যাপক জানাশোনার পাশাপাশি সমকালীন বিশ্ব ও তার সংকটগুলো বোঝার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জানতে হবে, কিভাবে আজকের বিশ্বে মানুষকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করা হয়।
প্রাজ্ঞ আলেমদের সাহচর্য : তরুণ আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, সময়সচেতন ও আল্লাহভীরু আলেমদের তত্ত্বাবধান ও সাহচর্য গ্রহণ করা। আজকাল অনেক তরুণের মধ্যে অতিমাত্রায় স্বাধীনচেতা মনোভাব দেখা যায়, যা তাদের মেধা, সময় ও শক্তিগুলোকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এদেশের মাদরাসাগুলোতে যে পরিমাণ মেধাবী ও পরিশ্রমি ছাত্র রয়েছে, যদি তাদের সঠিক পরিচর্যা হতো, তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, তাদের মধ্য থেকে বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য উপযোগী মানুষ তৈরি হতো। তাই ছাত্রদের মেধা ও প্রতিভাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য নিষ্ঠাবান, আল্লাহভীরু, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ দাঈদের পরামর্শ, সাহচর্য ও তত্ত্বাবধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজের বোঝা না হয়ে সামাজিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়া : তরুণ আলেম ও মাদরাসার ছাত্রদের দ্বীপে বসবাসকারীদের মতো জনবিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত নয়; বরং সমাজের সংঙ্গে প্রাসঙ্গিক থাকা অতীব জরুরি। সমাজের মানুষের প্রতিটি প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং কল্যাণমূলক সকল কাজে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ যেনো আলেমদের ভিনগ্রহের মানুষ কিংবা সমাজের বোঝা মনে না করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা-মদিনার যাবতীয় সংকটে-প্রয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। সুতরাং আলেমদের শুধু ওয়াজ-নসিহত আর নীতি বাক্য শুনানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হলে চলবে না; বরং মানুষের বিপদ-আপদে-সংকটে-দুর্যোগে সবার আগে আলেমদের এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড ও মানবেসেবার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীবাসী আজ নিজেদের হাতের অর্জনের ফলে বিপর্যস্ত পরিবেশ রক্ষা নিয়ে ভাবছে, কাজ করছে। অথচ নবী করিম (সা.) সেই সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেই ছিলেন পরিবেশ সচেতন, পরিবেশ রক্ষায় তাঁর ছিল বিভিন্ন উদ্যোগ ও ভূমিকা।
এদেশের আলেম উলামা ও ইমামদের প্রতি মানুষের যে অগাধ বিশ্বাস এবং ভালোবাসা রয়েছে, সেই আস্থা এবং বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তারা সমাজসেবায় বিপ্লব সাধন করতে পারে। প্রয়োজন কেবল দরদি মন, বিচক্ষণ চোখ এবং অদম্য কর্মস্পৃহার। অলসতা, আরামপ্রিয়তা, ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার মোহ একজন দাঈর জন্য আত্মঘাতী বিষ। সুতরাং ভোগবাদী মানসসিকতা পরিহার করে উম্মাহর সেবা করে যাওয়া হলো আদর্শ দাঈর কাজ। অনেকে মনে করেন, মানবিক ও সামাজিক কাজের জন্য বিপুল অর্থকড়ির প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে বহু সামাজিক কাজ আছে যেগুলোর জন্য অর্থ নয়, প্রয়োজন মানসিকতা এবং যথাযথ উদ্যোগ। নিজের সাধ্যের কাজটা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিলে মহান আল্লাহ পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়ার পথ সুগম করে দেন।
মতপার্থক্য নিরসন ও উম্মাহর ঐক্য চেষ্টা : আলেমদের অভ্যন্তরীণ বিভক্তির সুযোগ নিয়েই ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলো সবচেয়ে বেশি সফল হয়। ফলে, উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। মতভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু অহেতুক বাকবিতণ্ডা, আলোচনা-সমালোচনা, একে অন্যকে দোষারোপ করা এবং দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়া দিনশেষে ইসলামেরই ক্ষতি। সুতরাং অন্যের পেছনে লেগে না থেকে স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারলে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়বে ও দূরত্ব কমবে। তাই নিজ মাসলাক-মানহাজ যথাযথ পালন করেও ভিন্ন চিন্তার মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করা বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি বিষয়। বহুধাবিভক্ত উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলেও আমার কোনো কথা, কাজ কিংবা ভূমিকায় যেনো অন্তত উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি না বাড়ে। ইসলাম ও আলেমদের সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্ম না নেয়।
এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি সর্বদা মহান আল্লাহর নিকট হৃদয় নিংড়ানো দোয়ায় মশগুল থাকতে হবে। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর মা তাঁর সন্তানের জন্য দোয়া করতেন—‘আয় আল্লাহ, এক সে হাজারোঁ কি জরুরত পূরী ফরমা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমার সন্তান একা যেনো হাজারো মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।